ভারতের অর্থনীতি বাংলাদেশের ওপর কতটা নির্ভরশীল ?Economy of India

বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার৷ যদিও ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে, কিন্তু ভারতের অর্থনীতিও বাংলাদেশের উপর দারুণ ভাবে নির্ভরশীল। বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্যের হিসেবনিকেশ ভারতের অর্থনীতির উত্থান পতন অনেকাংশে প্রভাবিত করে।

ভারতের অর্থনীতি বাংলাদেশের ওপর কতটা নির্ভরশীল ?Economy of India


ভারতের সর্বোচ্চ রেমিটেন্স প্রাপ্তির দেশ বাংলাদেশ

ভারতের শীর্ষ রপ্তানি বাজারের তালিকায় অষ্টম স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। ভারতীয় সংবাদপত্র ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস এর দেওয়া তথ্য মতে, ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে ভারত বাংলাদেশে ১০০০ একশ কোটিডলার মূল্যের পণ্য বা সেবা রপ্তানি করেছে। এর মধ্যে দেশটি কেবল বিদ্যুতে রপ্তানি করেছে একশ কোটি ডলারের বেশি মূল্যের, যা মোট রপ্তানির 9.3%।বিদ্যুৎ ছাড়া ভারত গত অর্থবছরে বাংলাদেশে তুলা রপ্তানী করে ২৩৬ কোটি ৮৮ লাক্ষ ডলার জ্বালানী তেল, বিটুমিন ও অন্যান্য খনিজ পদার্থ রপ্তানী করে ২৩০কোটি ৭৬ লাখডলার রেল ও ইঞ্জিনের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ রপ্তানি করে। ৬০ কোটি ৩৪ লাক্ষ ডলার এবং পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের যন্ত্রাংশ রপ্তানি করে ৫৪ কোটি ৪৪ লাক্ষ ডলার আয় করেছে।এ ছাড়া ভারত বাংলাদেশে খাদ্যশস্য, চাল, চিনি ইত্যাদি রপ্তানি করে। অর্থাৎ বাংলাদেশের পণ্য এবং সেবা রপ্তানি করে ভারত৷ বিপুল পরিমাণ অর্থ আয় করে, যা তাদের জিডিপিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্যের গুরুত্ব উপলব্ধি করা যায়। ফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান এক্সপোর্ট অর্গানাইজেশনের মহাপরিচালক অজয় শাহের কথায় ।আগস্টের প্রথম সপ্তাহে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর তিনি বলেন, বাংলাদেশে রাজনৈতিক সঙ্কটের কারণে প্রায় তিনশ মিলিয়ন ডলার মূল্যের রপ্তানি বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে আমরা অনুমান করছি। আমরা প্রতিদিন বাংলাদেশে প্রায় ৩০মিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করি।বাংলাদেশের ওপর ভারতের অর্থনৈতিক নির্ভরতা দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক বিনিয়োগ এও দেখা যায়। .২০১৯সালের হিসেবে বাংলাদেশে ভারতের বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল তিন দশমিক ছয় বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বাংলাদেশে ভারতের বিনিয়োগ হয়েছে। মূলত বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, টেক্সটাইল এবং ফার্মাসিউটিক্যালস খাতে।শুধু রপ্তানি বাণিজ্য বিনিয়োগই নয়, বাংলাদেশে কর্মরত ভারতীয়রা প্রতিবছর বিপুল পরিমাণে রেমিট্যান্স পাঠানোর মাধ্যমে দেশটির অর্থনীতি চাঙ্গা রাখতে সহায়তা করেন।২০১৭ সাল থেকে ভারতে এ পর্যন্ত ১০বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিটেন্স গেছে বাংলাদেশ থেকে। ফলে বাংলাদেশ ভারতের সর্বোচ্চ রেমিটেন্স প্রাপ্তির দেশের তালিকায় চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে।

ভারতে রেমিটেন্স খাতে বাংলাদেশে প্রভাব কতটা?

বাংলাদেশ পুলিশের স্পেশ্যাল ব্রাঞ্চ এবং সুরক্ষা সেবা বিভাগের রিপোর্ট অনুসারে ২০২৩সালের ৩০ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে অবস্থানরত বৈধ বিদেশি নাগরিকের সংখ্যা ১,০৭,০০০ একশ ৬৭জন। যার মধ্যে ভারতীয় নাগরিকই কেবল ৩৭,০০০, চারশ ৬৪জন।সদ্য সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী গত জুনে সংসদে জানিয়েছিলেন, চলতি অর্থবছরের এপ্রিল থেকে জুলাই পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে ৫,০০,০০,০০০ ছয় লাখ ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছে ভারতীয়রা। তবে এগুলো সরকারি হিসাব যা ভারতের বৈধ অভিবাসীদের আমলে নিয়ে করা হয়।কিন্তু অর্থনীতিবিদ এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশে বসবাসকারী ভারতীয়র সংখ্যা বেসরকারি ভাবে অনেক বেশি এবং তাদের পাঠানো রেমিটেন্সের পরিমাণও বিশাল।সাবেক পররাষ্ট্রসচিব মোহাম্মদ তৌহিদ হোসেন গণমাধ্যমকে দেওয়া এক সাক্ষাত্ কারে জানিয়েছিলেন, আনঅফিসিয়ালি বাংলাদেশ থেকে পাঁচ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স যায় ভারতে। এই পরিসংখ্যান থেকে ভারতে রেমিটেন্স খাতে বাংলাদেশে প্রভাব কতটা তা স্পষ্ট হয়ে যায়।

এক লাখেরও বেশি ভারতীয় অবৈধভাবে কাজ করেন বাংলাদশে

জার্মান গণমাধ্যম ডয়চে ভেলে তাদের একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করে বাংলাদেশের পোশাক খাতে ভারতের অবস্থান বেশ শক্ত।বাংলাদেশের পোশাক খাতে ডিজাইন সহ আরও কয়েকটি বিষয়ে দেশের দক্ষ জনশক্তির অভাব থাকায় এসব পদে ভারতীয়রা জায়গা করে নিচ্ছে। তাছাড়া বাংলাদেশে পোশাকের বায়ার হাউসগুলো নিয়ন্ত্রণ করে ভারতীয়রা। ফলে পোশাক কারখানাগুলো বায়ার পেতে তাদের কারখানায় মার্কেটিং এবং হিসাব বিভাগে ও ভারতীয়দের নিয়োগ দেন।গার্মেন্টস সংশ্লিষ্টদের মতে, বাংলাদেশের পোশাক কারখানাগুলোতে এক লাখেরও বেশি ভারতীয় কাজ করেন। অন্যদিকে বায়িংন হাউসের এই সংখ্যা আরও অনেক বেশি।এর বাইরে বাংলাদেশের আইটি খাতে অভারতীয়রা দাপটের সঙ্গে কাজ করছেন। এছাড়া আরও অনেক সেবা খাত। এমনকী বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম বিজ্ঞাপন, কনসালটেন্সি ইত্যাদি খাতেও অসংখ্য ভারতীয় কর্মী রয়েছেন।তাঁদের বেতনও অনেক বেশি। সব মিলিয়ে বাংলাদেশে কম করে হলেও ৫,০০,০০০ ভারতীয় কাজ করেন বলে ধারণা করা হয়। ফলে ভারতীয়দের কর্মসংস্থানেও বাংলাদেশের অবিশ্বাস্য অবদান রয়েছে।দুঃখজনক ব্যাপার হল, বাংলাদেশে কর্মরত অধিকাংশ ভারতীয়ই কোনও ওয়ার্ক পারমিট নেই। তারা টুরিস্ট ভিসা কিংবা এ-ভিসা বা বি-ভিসায় বাংলাদেশে কাজ করছে। আর এসব ভিসায় যাঁরা কাজ করেন তাঁদের রোজগারের পুরো অর্থই অবৈধ পথে বাংলাদেশে বাইরে চলে যায়।

ভারতের পর্যটন ও মেডিক্যাল ট্যুরিজমে বাংলাদেশের অবধান

এদিকে ভারতের পর্যটন শিল্পকে ও এক অর্থে বাঁচিয়ে রেখেছেন বাংলাদেশি পর্যটকরা।ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য ইকনমিক টাইমস এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতের জন্য বিদেশি পর্যটকদের প্রায় এক চতুর্থাংশ বাংলাদেশি ।পর্যটন সংশ্লিষ্টদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত বছর ভারতে ৯২,৩০,০০০ পর্যটকের সমাগম হয়েছে। এতে দেশটির আয় হয়েছে ২৪,০০০ সাতশ ₹৭,০০,০০,০০০। এই পর্যটকদের মধ্যে শুধুমাত্র বাংলাদেশি পর্যটক ছিল ২২.৫%। কোনো একক দেশ থেকে ভারতে সবচেয়ে বেশি পর্যটক যায় বাংলাদেশ থেকেই।চলতি বছরের জুলাই মাস থেকে বাংলাদেশে কোটা সংস্কার আন্দোলন এইতো শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশে এখনও রাজনৈতিক অস্থিরতা বিরাজ করছে। এই অস্থিরতা ভারতের পর্যটন শিল্পে মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। সাময়িকভাবে বাংলাদেশ ভারত ফ্লাইট বিঘ্নিত হয় এবং মেডিকেল ভিসা বাদে বেশিরভাগ ভিসা স্থগিত হয়ে যাওয়ায় ভারতগামী বাংলাদেশির সংখ্যা ৯০ শতাংশের বেশি কমে গেছে।ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন অব ট্যুর অপারেটর্স ওয়েস্ট বেঙ্গল চ্যাপ্টার জানিয়েছে, এর ফলে পশ্চিমবঙ্গে হাসপাতাল সংলগ্ন ট্রাভেল অপারেটর হোটেল ও গেস্ট হাউসগুলোর ব্যবসা ৯০% কমে গেছে। ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের একজন পরিচালক বলছেন, এই পরিস্থিতিতে ভারত প্রতি মাসে সাতশ ₹৫০,০০,০০,০০০ হারাচ্ছে, যা ভারতের অর্থনীতির জন্য বিশাল একটি ধাক্কা।যদিও পর্যটন খাতে বাংলাদেশিদের কাছ থেকে ভারত মাসে আনুমানিক সাতশ ₹৫০,০০,০০,০০০ উপার্জন করে বলে মনে করা হয়। কিন্তু বাস্তবে এর চেয়ে বেশি অর্থ বাংলাদেশিরা ভারতের খরচ করেন। কারণ চিকিত্সার জন্য যেসব বাংলাদেশি ভারতে যান, তাঁরা সাধারণ ট্যুরিস্টদের চেয়ে অনেক বেশি অর্থ ব্যয় করেন। ভারতের হেল্থ ট্যুরিজম ডিপার্টমেন্টের তথ্য অনুযায়ী, গত কয়েকবছরের মধ্যে ট্যুরিজম ট্র্যাভেল ৮৪% বেড়েছে।২০২১ সালের জরিপে দেখা গেছে, বছরে ২৪,৭০,০০০ মেডিক্যাল টুরিস্ট বাংলাদেশ থেকে ভারতে যাচ্ছেন শুধু বাংলাদেশ থেকে ভারতে যাওয়া মানুষরা মেডিক্যাল ট্যুরিজমে ৫০০০ কোটি টাকার বেশি খরচ করে থাকেন।

বাংলাদেশ ভারতকে যে সকল সুবিধা দিয়ে থাকে

এদিকে ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য যথা ত্রিপুরা, আসাম, নাগাল্যান্ড, মণিপুর, অরুণাচল প্রদেশ, মেঘালয়, সিকিম ও মিজোরামের বাণিজ্য অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও প্রবল ভাবে বাংলাদেশের উপর নির্ভরশীল। গতবছর বাংলাদেশ সরকার ভারতের ত্রিপুরা ও অন্যান্য উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যের ব্যবসায়ীদের পণ্য পরিবহণে চারটি পথ অনুমোদন করে। এর ফলে ভারতের বৈধ যেকোন পণ্যের চালান সমুদ্রপথে মোংলা এবং চট্টগ্রাম বন্দরে খালাস হচ্ছে।এবং সে সব পণ্য বাংলাদেশে সড়কপথে পরিবহণ ব্যবহার করে চারটি স্থলবন্দর হয়ে ভারতে যাচ্ছে অথবা ভারত থেকে আসছে। অতীতে প্রায় ১৬০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে এবং দীর্ঘ সময় ব্যয় করে ভারতের বিভিন্ন স্থান থেকে ত্রিপুরা ও মেঘালয়ে পণ্য আনা নেওয়া করা হতো। মোংলা এবং চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে পণ্য পরিবহনের সময় এবং খরচ বহুলাংশে কমে গেছে৷ ভারতের বিবেকানন্দ ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশনের সিনিয়র ফেলো।শ্রীরাধা দত্তের মতে, মংলা বা চট্টগ্রাম বন্দরের পূর্ণাঙ্গ ব্যবহার করতে পারলে ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলের বাণিজ্যের চিত্র পুরোটাই পরিবর্তিত হয়ে যাবে। তার উপর গত জুনে বাংলাদেশের ভূখণ্ডের উপর দিয়ে ভারতের ট্রেন চলাচলের অনুমতি পেয়েছে ভারত৷ ফলে ভারতের অন্য সব রাজ্যগুলো সেভেন সিস্টার্স এর সঙ্গে আরও সহজে ও স্বল্প ব্যয় ব্যবসা বাণিজ্য করতে পারবে।তরল গ্যাস পরিবহনেও বাংলাদেশের উপর নির্ভরশীল ভারত ২০১৯ সালের ৫ অক্টোবর বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লি সফরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে সাক্ষাতের সময় উভয় দেশের মধ্যে একটি সমঝোতা হয়। সে অনুযায়ী বাংলাদেশ ত্রিপুরার ইঞ্জিন কর্পোরেশনে ওএনজিসির বিশাল ঘর বটলিং প্ল্যান্টে ট্যাঙ্কারে করে জল সরবরাহের সম্মত হয় এবং ইন্ডিয়ান অয়েল কর্পোরেশন বাংলাদেশের ব্যক্তিমালিকানাধীন ও মেয়েরা বেক্সিমকো ও বিএনআর যে পেট্রোলিয়ামের মাধ্যমে।উত্তর পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর জন্য এলপিজি আমদানি করতে শুরু করে। অতীতে ভারতের কলকাতার হলদিয়া বন্দর থেকে শিলিগুড়ি পার হয়ে আগরতলায় তরল গ্যাস পরিবহণে ১০০০ ছয়শ ৪০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হতো। কিন্তু বাংলাদেশের সহায়তায় বাংলাদেশ থেকে ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে এলপিজি সরবরাহ করতে মাত্র দুইশ ৫০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হচ্ছে। যার ফলে ভারতের প্রচুর অর্থ সাশ্রয় হচ্ছে এবং তাদের উত্তরপূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর উন্নয়ন ত্বরান্বিত হচ্ছে।সব মিলিয়ে এক কথায় বলা যায়, বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অবনতি হলে তার মারাত্মক প্রভাব পড়বে ভারতের অর্থনীতির ওপর।

আরো পড়ুন...

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

প্রবাসী বাংলার নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url